“Fear is good, it tells you where the edge is.”
মাঝরাত।
আমি আর সালেহীন ভাই তার বাড়ির ছাদে বসে আছি। উনি তার জীবনের একটা গল্প শোনাবেন।
সালেহীন ভাই বেশখানিকটা সময় নিয়ে দু’কাপ কফি বানালেন। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বড় সড় একটা টান দিয়ে বললেন, “ঘটনাটা কিন্তু বড়। যদি শুরু করতে চাই তাহলে অনেক পেছন থেকে শুরু করতে হবে। পুরোটা শোনার ধৈর্য্য হবে তো?”
“অবশ্যই। এ নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।”
সালেহীন ভাই বলা শুরু করলেন। তার গল্প বলার দক্ষতা অসাধারণ। মিনিট খানেকের মধ্যেই তিনি আমাকে তার ঘটনায় একেবারে গেঁথে ফেললেন। আমি তন্ময় হয়ে শোনা শুরু করলাম।
আবহাওয়ায় ঝড়ের আভাস। গায়ে কাঁটা দেওয়া হিম শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছিলো একটু পর পর। রাত বাড়ার সাথে সাথে ইমতিয়াজ সালেহীনের গল্পও গভীর হওয়া শুরু করলো।
তিনি বলতে থাকলেন। বিরতিহীন। একটানা।
একটা সময় আমি তার গল্পে এতোটাই মগ্ন হয়ে গেলাম যে মনে হচ্ছিলো সবকিছু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। শরীর জমে গেলো। নড়বার শক্তি পাচ্ছিলাম না। পায়ের পাতায় যেনো শিকড় গজিয়েছে।
একসময় আমি প্রবল আতংক নিয়ে দৌড়ানো শুরু করলাম। আমার আশপাশটা এমনভাবে অন্ধকার হয়ে গেলো যে হঠাৎ মনে হল আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমার মাথায় শুধু কাজ করছিলো যেকোনো মূল্যে আমাকে এই বাড়ি থেকে বের হতে হবে।
পেছন থেকে শুনতে পেলাম, “ওকে ধরো, যেভাবে পারো ওকে ধরো। ওকে আমার লাগবেই! ধরো ওকে! অল্পবয়সী একটা ছেলেই আমার দরকার!”
“মাঝরাতে একটা গল্প শুনিয়েছিলেন” নসিব পঞ্চম জিহাদী’র প্রথম বই। আর প্রথম বইতেই বাজিমাত। আমি বলবো থ্রিলার লাভারদের জন্য এই বইটা মাস্টরিড।
প্রথমত, গল্পের প্লটটা দারুণ ও আলাদা। এই প্লটে গল্প সচরাচর দেখা যায় না। দ্বিতীয়ত, লেখকের গল্প বর্ণনার ধরন প্রশংসনীয়। বিশেষ করে প্রথম বই হিসেবেতো এক কথায় অসাধারণ। সেই সাথে চরিত্র তৈরি। অল্প চরিত্র, কিন্তু কাজে অনেকদূর।
এই বইটিকে একটি গথিক থ্রিলার বলা যায়। বইতে মূল গল্প একটা। কিন্তু এরমধ্যে আরো অসংখ্য গল্পের মিশেল দেখা যায়। গল্পের মধ্যে গল্প, তার মধ্যে আবার গল্প, পাশাপাশি আরেকটা গল্প! এভাবেই চলেছে পুরো বইয়ের মূল গল্পটি। এ গল্পগুলোতে ভৌতিক আবহ আছে, ইতিহাস আছে, মিথ আছে, কিছু বৈজ্ঞানিক বিষয় আছে। আর আছে রহস্য। একেবারে আগাগোড়া রহস্যে পরিপূর্ণ।
মানুষের সাইকোলজি নিয়ে দারুণ খেলেছেন লেখক। প্রতি পাতায় পাতায় গল্পের দৃশ্য পাল্টেছে। পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল এক; কিন্তু শেষে গিয়ে দেখলাম সব ভাবনা উল্টে গেলো!
গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইন্টারেস্টিং। পাঠক ধরে রাখার মতো ভরপুর উপাদান রয়েছে এই গল্পে। কোথাও গতির কমতি হয়নি। সবমিলিয়ে এক কথায় চমৎকার একটি লেখা। যারা এখনো পড়েননি, আর দেড়ি না করে পড়ে ফেলুন।
“ফুল লাগলে চেয়ে নিবেন” কথাটা বইতে অনেকবার দেখা গেছে। এই নামেই লেখক “মাঝরাতে একটা গল্প শুনিয়েছিলেন”র দ্বিতীয় পর্ব “ফুল লাগলে চেয়ে নিবেন” লিখেছেন। ওটা এখনো পড়া হয়নি। আশা করি ওটাও এটার মতোই দারুণ হবে।
লেখকের এই কথাটুকু আমার খুব পছন্দ হয়েছে, “আমি কোন কাজই ঠিকমতন করতে পারি না। এই কিছু না পাড়ার মধ্যেই মোটামুটি ভাবে কাজ চালানোর মতন যে কাজটা আমি সব থেকে ভালো পারি সেটা হচ্ছে গল্প বলা। মুখে বলা গল্পেরই একটা লিখিত সংস্করণ হচ্ছে এই বই। সেক্ষেত্রে একজন গল্প কতখন হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবো।”
তিনি আসলেই একজন দুর্দান্ত গল্প কথক।
আবুল ফাতাহ মুন্না ভাইয়ের করা এই বইয়ের প্রচ্ছদটা মোটামুটি। সিম্পলের মধ্যে ভালোই বলা যায়। তবে আরো ভালো হতে পারতো।
বুক স্ট্রিটের বইয়ের পেইজ, বাঁধাই বরাবরই ভালো। এই বইয়ের ক্ষেত্রেও তাই। বানান ভুলত্রুটিও নেই বলবেই চলে।
ফ্ল্যাপ থেকে
অনেকটা হঠাৎ করেই সৌধ নামের এক তরুণ ক্যাফে বুকওঅর্ম নামের একটা লাইব্রেরি’র লাইব্রেরিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে যায়। এক ঝড়বৃষ্টির রাতে সেখানেই ওর পরিচয় হয় ইমতিয়াজ সালেহীনের সাথে।
ভদ্রলোক একটু রহস্য করে কথা বলতে পছন্দ করেন। গল্প বলার সময় মানুষকে একদম মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারেন তিনি। বিশেষ করে ভৌতিক কিছু বর্ণনা করার সময় কণ্ঠ আর ভাষা দিয়ে এমন একটা আবহ তৈরি করেন যে ভয় না পেয়ে উপায় থাকে না। বিচিত্র সব গাছপালায় ঘেরা এক ছাদে সৌধকে একদিন তার জীবনের একটা গল্প শোনান তিনি। সেই গল্প শুনে তীব্র ভয় গ্রাস করে ফেলে সৌধকে। সে কোনমতে পালিয়ে আসে সেখান থেকে। আর এরপর থেকেই প্রবল একটা দুঃস্বপ্ন ওকে তাড়া করতে শুরু করে।
নবাবদের আমলে আর্মেনিয়ানদের ছোট একটা দল সাথে করে একটা জিনিস নিয়ে এসেছিলো এই দেশে। যেটাকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার জন্য মধ্যযুগ থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অল্টারনেটিভ হিস্ট্রিতে নবাবদের পতনের পেছনেও এই নিষিদ্ধ জিনিসটাকে দায়ি করা হয়ে থাকে।
কিন্তু এর সাথে একজন সাধারণ লাইব্রেরিয়ানের সম্পর্ক কী? আর একটা গল্প শুনেই বা সে এতো ভয় পেলো কেনো..?!
একটা সিক্রেট বলি, আপনারা কাউকে বইলেন না। এক মাঝরাতেই আমি এই বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম। পড়তে পড়তেই কখন যেনো ঘুমিয়ে গেলাম। ঘণ্টাখানিক পর এই বইয়ের ভয়ংকর কাহিনিগুলোই স্বপ্নে দেখে ভয় পেয়ে ঘুম ভেঙে গেলো। তারপর আর চোখে ঘুম নেই। অগত্যা, আবার পড়া শুরু করে দিলাম। ভোরবেলা বই শেষ করে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।