মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কত প্রাণ হলো বলিদান
লেখা আছে অশ্রুজলে – “মোহিনী চৌধুরী”
শৈশব-কৈশোর মফস্বলে কাটলেও গ্রামের বাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় ছোটোবেলায় আমার বেশ কিছু সময় কেটেছে গ্রামের বাড়িতে। সেখানে বাবা-চাচা-দাদার মুখে মুক্তিযুদ্ধের নানা গল্প শুনেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। পরবর্তীতে আমি মুক্তিযুদ্ধের ওপর কিছু বইপত্র আর ইন্টারনেটের সুবাদে অল্পবিস্তর পড়াশুনা করেছি। কিছু বিষয় বারবার পড়ায় সেগুলি মাথায় গেঁথে গেছে, কিছু বিষয় মনে রাখতে পারিনি, আর কিছু বিষয়ে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও কেন যেন খুব বেশি তথ্য সংগ্রহে আসেনি। খেয়াল করে দেখলাম, আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর শত শত বই থাকলেও ’৭২ থেকে ’৭৫ সালের ভেতরে ঘটে যাওয়া রাজনীতির নানা উত্থান-পতন নিয়ে লেখা বই তুলনামূলকভাবে কম। এর মধ্যে বেশিরভাগই সিরাজ সিকদারের ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’ বা ‘সর্বহারা রাজনীতি’-কে পাশ কাটিয়ে গেছে বা কোনোরকমে ছুঁয়ে গেছে। টুকটাক যা আছে তাতে তথ্য অপ্রতুল। তাই লেখার শুরুতেই ধন্যবাদ লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদকে, বাংলাদেশের রাজনীতির সেই অস্থির সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিস্মৃত দল ও দলের প্রধান সিরাজ সিকদারকে নিয়ে তার লেখা এই বইটির জন্য।
বইয়ের সংক্ষিপ্তসার
‘লাল সন্ত্রাস : সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি’ বইটি মূলত দুটি পর্বে সাজানো। প্রথম পর্বে আছে ঘটনাক্রমের বিবরণ। আর দ্বিতীয় পর্বটি সাজানো হয়েছে সর্বহারা পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষদের জীবনের গল্প দিয়ে।
১৯৬৫ সালে ছাত্র ইউনিয়ন সোভিয়েত ও চীন, এ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে সিরাজ সিকদার তার নিজস্ব দর্শনের কারণে চীনপন্থী অংশে থাকেন। ঐসময় তার মনোজগতে ব্যাপক বদল ঘটে। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৬৭ সালে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট সিরাজ সিকদার বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর নতুন পথের সন্ধান করতে থাকেন। খুঁজতে থাকেন তার মত একই দর্শন লালন করেন, এমন কিছু সহযাত্রী। পেয়েও যান।
দলের শুরুটা হয়েছিল তাত্ত্বিক ভিত্তির খোঁজে একটি থিসিস লেখার মধ্য দিয়ে। সেখানে তুলে ধরা হয়, কে শত্রু কে মিত্র। দক্ষিণ ভিয়েতনামের গেরিলাযুদ্ধ এবং ভিয়েতকংদের বীরত্বের কথা শুনে মুগ্ধ হন সিকদার ও তার সঙ্গীরা। এসময় সিকদার দ্য ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড-এ চাকরি নিয়ে টেকনাফে অবস্থান করছেন। সিকদারের সঙ্গীরা টেকনাফে যেতে চান। উদ্দেশ্য—আরাকানের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে কথা বলা। সিরাজ সিকদারের পরামর্শ অনুযায়ী ১৯৬৮ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে সামিউল্লাহ আজমী, রাজিউল্লাহ আজমী, আনোয়ার হোসেন ও আবু সাঈদ (কর্ণেল তাহেরের ভাতৃদ্বয়), আকা ফজলুল হক সহ সর্বমোট নয় জন গেলেন আরাকানে। কিন্তু তাদের গাইড ট্রটস্কিবাদী রেড ফ্লাগ উপেক্ষা করে মাওবাদী হোয়াইট ফ্লাগ কমিউনিস্ট পার্টির সাথে কথা বলতে গিয়ে যখন সাতদিনেও ফেরে না, তখন তাৎক্ষণিকভাবে রণে ভঙ্গ দেন তারা। এখান থেকেই মূলত গল্পের শুরু। আর ইতিহাসের এই ঘোরলাগা বাস্তবকে দারুণ এক গল্পে কাঠামো দিয়েছেন লেখক!
পাকিস্তানের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ১৯৬৮ সালের শুরু থেকেই সিকদার ও তার সহযোগীরা রাজনৈতিক দল হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টি তৈরির কথা ভাবতে থাকেন, যার দানা বাঁধে একই বছরের মাঝামাঝিতে। উর্দু-আরবি-ইংরেজি মেশানো তৎকালীন সব দলগুলোর মধ্যে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় একটি রাজনৈতিক দলের নাম রাখেন সিকদার ও তাঁর সহযোগিরা—পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন। সবাই একমত হন, এটি হবে গোপন সংগঠন। সে উদ্দেশ্যে দলের সবার ছদ্মনাম, জায়গাভেদে আবার সে ছদ্মনামের পরিবর্তন এমনকি গোপনীয়তা রক্ষার উদ্দেশ্যে দলের সবাই মিলে একসাথে মিটিংয়ে না বসে খণ্ড খণ্ড আকারে মিটিং করার মত দারুণ কার্যকরী উদ্যোগ নিয়েছিলেন সিরাজ সিকদার।
পার্টির পক্ষ থেকে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ ছাড়াও সাধারণ জনগণ ও বিভিন্ন পার্টির উদ্দেশ্যে দারুণ সব খোলা চিঠি আর মেনিফেস্টো লেখেন সিরাজ সিকদার। এ বইতে দেখা মিলবে সেসবের। পাশাপাশি আরো দেখা মিলবে দেশের জন্য সাস্টেইনেবল কর্মকাণ্ডের রূপরেখা বিষয়ক দলের মতামত। সিরাজ সিকদারের দুরভিসন্ধি যে কী মারাত্মক ছিলো, তা বোঝা যায় দলের এইসব ইশতেহার, খোলা চিঠির মাধ্যমে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবস্থানকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু তথ্যসহ দেখা মিলবে মুক্তিবাহিনীর বিশ্বাসঘাতকতা, লুটতরাজ, নির্মমভাবে খুন করার দালিলিক প্রমাণ। আসবে মহিউদ্দিন আহমেদের নিজস্ব বক্তব্য-ও। বইটি পড়তে পড়তে বেশ কিছু জায়গায় পাঠক থামবেন, ভাববেন, প্রয়োজনে তথ্য ক্রসচেক করবেন, কিন্তু আবার ফেরত আসবেন। পড়া শুরু করবেন—বুকমার্ক করে রাখা অংশ থেকে।
১৯৭২-৭৪ সালে দুইটি রাজনৈতিক স্রোতধারা—জাসদ ও সর্বহারা পার্টি, তৎকালীন বাঙালী তরুণ সমাজকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। বিপ্লবী চেতনায় উদ্ধুদ্ধ করার পাশাপাশি সশস্ত্র সংগ্রামেও অংশগ্রহণ করেছিল তারা। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুখ থুবড়ে পড়ে সর্বহারা পার্টি। অন্যান্য পার্টির মতো সর্বহারা পার্টিও যে ‘উপদলবাদ’ বা ‘গ্রুপিং’ এর আওতার বাইরে নয়, এটা উঠে এসেছে বইতে। এছাড়া পার্টির ঘোষিত নীতি ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’-র ‘গণতন্ত্র’ ও ‘কেন্দ্রিকতা’ টার্ম দুইটি পারস্পারিক ভারসাম্যহীনতায় অবস্থান করার কারণে সৃষ্ট সমস্যাবলিও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন লেখক। মূলত কমিউনিস্টদের সাথে স্থানীয় গণমানুষের বিচ্ছিন্নতা, এক পর্যায়ে পার্টির গণতন্ত্রহীনতা, এক ব্যক্তির নেতৃত্ব কায়েম হওয়া, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে অন্ধ উত্তেজনা থেকে আন্তঃদলীয় কিলিংগুলো নিজেদের একতাবদ্ধ হওয়ার প্রসঙ্গকে প্রশ্নের ওপর দন্ডায়মান করে ফেলে। জাতীয়তাবোধের অভাবহীনতার পেছনে দলীয় ভিন্নমত পোষণ থাকলেও মিউচুয়াল রেস্পেক্টের যে প্রচন্ড অভাব, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন মহিউদ্দিন আহমদ। বহিঃশক্তি রোধের অভিপ্রায়ে থাকা দল নিজেদের ভেতর অন্তঃকোন্দলে লিপ্ত থাকলে বৃহৎ স্বার্থ থেকে যে যোজন যোজন দূরে ছিটকে যায়, সে সত্য দারুণভাবে উঠে এসেছে বইতে।
তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সর্বহারা পার্টির মতো একটা রাজনৈতিক দলের সভাপতি সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর অনেক বছর পরেও সঠিকভাবে জানা যায়নি ঠিক কীভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। ধরা পড়ার ব্যাপারটা জানলেও তার মৃত্যু কার্যকর করার পদ্ধতি নিয়ে নানা মত দেখা যায় এখনও। বাঙালীর ইতিহাসের সাথে মিশে থাকা এরকম একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও তার সর্বহারা রাজনীতির তত্ত্ব, রূপকল্প ও কর্মসূচি এবং একঝাঁক মেধাবী তরুণের স্বপ্নযাত্রা ও স্বপ্নভঙ্গের গল্প তুলে ধরার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি ইতিহাসকে সুস্পষ্টভাবে সামনে আনার জন্য এ বিষয়ে আরো গবেষণা, লেখালিখি দরকার। আর সে জায়গা থেকেই লেখক মহিউদ্দিন আহমদেকে আরো একবার ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
বইটির ভালো দিক
ইতিহাস পড়তে যাতে একঘেয়েমি না চলে আসে সেদিকে লেখকের নজর ছিল বরাবরই। সেজন্য তিনি সর্বহারা পার্টির সাথে জড়িতদের সাক্ষাৎকার বা রচনা নিয়ে বইটির দ্বিতীয় পর্ব সাজিয়েছেন৷ এতে দলের ভেতরকার অন্তর্দৃষ্টি সামনে এসেছে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বলে আমার মনে হয়েছে। বইটিতে বেশ কিছু ছবি, দলিল ও চিঠি ব্যবহার করা হয়েছে৷ অসংখ্য বই রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মহিউদ্দিন আহমদ তথ্য-উপাত্তের একত্রীকরণ করে তিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গ কাঠামো থেকে ঘটনাগুলিকে নিজে দেখেছেন এবং পাঠকদেরকে দেখতে সাহায্য করেছেন। শুধু তাই-ই নয়, নিজের কিছু মূল্যবান মতামতও পরতে পরতে জুড়ে দিয়েছেন, যা নিঃসন্দেহে বইটিকে অনন্য করে তুলেছে।
বইটির খারাপ দিক
ইতিহাস নিয়ে লেখার সবথেকে বড়ো সমস্যার গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো একটা নির্দিষ্ট সময়কে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনাকে ব্যাসার্ধ মেনে তৈরিকৃত বৃত্তের ভেতরে কথা বলতে বলতে কথাপ্রসঙ্গে বৃত্তের পরিধির বাইরের কথা চলে আসে যা কোনো লেখক উপেক্ষা করে যেতে পারেন না। লেখক কতটুকু বলবেন আর পাঠক কতটুকু চাইবে, তার সামঞ্জস্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় না। লালসন্ত্রাস : সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি বইয়ে-ও এ বিষয়টি এসেছে।
‘উপনিবেশবাদ’ নাকি ‘জাতিগত নিপীড়ন’—কোনটি প্রধান দ্বন্দ্ব—এ নিয়ে কোনোরকম আলোচনায় যাননি লেখক। আবার ‘ছয় পাহাড়ের দালাল’ টার্মটা বেশ কয়েকবার উল্লেখ করলেও এটা নিয়েও কোনো গবেষণার ছাপ পাওয়া যায়নি। যেহেতু গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিভিন্ন ইনসাইট নিয়ে কম-বেশি আলোচনা করেছেন, এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন ছিল বলে আমি মনে করি।
’৭৫ সালে সিকদার মারা যাওয়ার পর থেকে ’৯০ সাল পর্যন্ত সর্বহারা দলের কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য এসেছে খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে যা পাঠকের জমে থাকা তৃষ্ণা মেটাতে খানিকটা ব্যর্থ হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে।
বইয়ের স্বার্থকতা
বইটিতে কোনোরকমে কমিউনিস্ট আন্দোলনের লাল-সাদা তত্ত্বের ভিত্তি উঠে এসেছে যাতে করে এই বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ কোনো ব্যক্তিও একটা ন্যূনতম ধারণা নিয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু যদি কেউ মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, মাও সে তুং নিয়ে হালকা পাতলা পড়াশুনা করে থাকেন, বইটির নামকরণ কতটা যুক্তিসঙ্গত—অনুধাবন করতে পারবেন৷ এছাড়া বইয়ের মলাট, কাগজ, বাঁধাই সবকিছুই অত্যন্ত মানসম্মত। আলাদাভাবে প্রচ্ছদ নিয়ে বললে বলতে হয় যে, লাল রঙের গুরুত্ব, মাহাত্ম্যের সাথে সিরাজ সিকদারের সম্পর্কের যথাযথ মূল্যায়ন করে দারুণ প্রচ্ছদে বইটিকে সাজিয়েছেন প্রচ্ছদশিল্পী সব্যসাচী হাজরা।
কেন পড়বেন, কারা পড়বেন
দেশের কন্টেক্সটে সংক্ষিপ্ত আকারে বামপন্থী রাজনীতির সূত্রপাত এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের একজন ব্যর্থ-উচ্চাভিলাষী-আদর্শবাদী-স্বপ্নাবিষ্ট বিপ্লবী ও তার দলের গল্প, মোদ্দাকথা, দেশের কিছু অবহেলিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস সঠিকভাবে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জানতে চাইলে… বইটি আপনার জন্য।
ইম্প্যাক্ট
বইটি আমাকে ১৯৬৭ থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সিরাজ সিকদার ও তার দলের সাথে দারুণ এক যাত্রায় সঙ্গী করেছে। একেকটা ঘটনাকে ভিন্ন ভিন্ন পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে দেখতে সাহায্য করেছে। বইটি শেষ করার পর আমি আমার বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব পেয়েছি, কিছু পাইনি এবং কিছু নতুন প্রশ্নের উদয় হয়েছে।