চাপাডাঙ্গার ব‌উ-তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় (Chapadangar Bou)


চাপাডাঙ্গার ব‌উ বইয়ের লেখক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় (Chapadangar Bou)

বিভূতিভূষণের উপন্যাস মোটামুটি সব শেষ করে ফেলার পর আমার মধ্যে হতাশা কাজ করছিলো,এরপর কি পড়বো? এখন আর সেই ভয় নাই। কারণ তারাশঙ্কর সেই অভাব নিশ্চিতভাবেই পূরন করবেন। চমৎকার লেখার গাঁথুনি,কাহিনী বিন্যাস,গ্রামীন জীবনের দারিদ্র্যতার,সুখ দুঃখের গল্পের সুনিপুণ বর্ননা দিয়ে তারাশঙ্কর আমার হৃদয় হরন করিলেন। সাধু ভাষায় লেখা এই দুই লেখকের লেখনীতে আমি রীতিমত নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।

রিভিউ- সেতাপ ও মহাতাপ দুই ভাই। দুইজন সম্পূর্ণ দুই মেরুর। একজন যেমন হাড় জিরজিরে শান্তশিষ্ট,বিষয়প্রেমী ও কৃপণ আরেকজন তেমন‌ই খরুচে,পরিশ্রমী,নেশারু এবং স্পষ্টভাষী। একজন ব্যবসা ছাড়া,কাজ ছাড়া কিছু বোঝে না আরেকজন যাত্রা ছাড়া,চাষ ছাড়া কিছু বোঝে না। এদের দুজনের দুটো ব‌উ আছে। কাদম্বিনী ও মানদা। দুজনেই জ্ঞাতি,চাঁপাডাঙ্গা নামক গ্রামে তাদের বাড়ি।

মানদার একটি ছেলে আছে কিন্তু কাদম্বিনী নিঃসন্তান। বড় ব‌উ কাদম্বিনীর সাথে দেবর মহাতাপের একটু অতিরিক্ত রকমের ভালো সম্পর্ক। বদরাগী দেবরকে বড় ব‌উ ছাড়া কেউ শান্ত করতে পারে না। বড় ব‌উ‌ও দেবরকে না খাইয়ে নিজে খায় না। তার কিপ্টা স্বামী কোনোভাবেই দেবরকে সিকি পরিমাণ বিষয় আশয়ে ঠকিয়ে দেবে, কাদম্বিনী থাকতে সেই উপায় নেই।

দেবর ভাবীর এরকম সম্পর্ক আমাদের সমাজ কি ভালোভাবে দেখে? কখনোই দেখে না। তার ওপর সেটা গ্রাম। স্বাভাবিকভাবেই কথা ওঠে।‌ দেবর যখন মাঠে কাজ করে তখন‌ও তার জন্য খাবার নিয়ে যায় তার ব‌উ নয়,বড় ব‌উ। টিকুরীর খুড়ি বলে একজন মহিলা আছেন যার মুখে কোন কথা বাঁধে না।‌ চুন থেকে পান‌ খসলেই রাস্তার মাঝখানে দাড়িয়ে গালাগালি,শাপশাপান্তের মাঝে দেবর ভাবীর এই সম্পর্ক নিয়ে টিটকারি মারতে সে ছাড়ে না। তার কথা থেকে আরো দশজনের, তারপর একশজনের মনে সন্দেহ তৈরি হয়।

কিন্তু কাদম্বিনী আর মহাতাপের সম্পর্ক আসলে কি? সেই ছোটবেলায় যখন সে বিয়ে হয়ে ব‌উ হয়ে আসে তখন থেকে দেখছে মহাতাপকে। একসাথে খেলা করেছে। রান্নাবাটি খেলায় কাদম্বিনী সবসময় মহাতাপের মা হয়ে তাকে শাসন করতো। আর তাই দেখে তার শ্বাশুড়ি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলতেন,ওকে তোর হাতে দিয়ে গেলাম,তুই হবি ওর মা। মা ছাড়া যে ও একেবারেই থাকতে পারে না!

কিন্তু সমাজ তার কতটুকু জানে? সমাজের কাজ শুধু‌ই কুৎসা রটানো। শ্বাশুড়ি বৌমাতে,জায়ে জায়ে সবসময় ঝগড়া হবে,ভাইয়ে ভাইয়ে হাঁড়ি আলাদা হবে এসব‌ই তাদের কাছে নিত্য স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু ভাইয়ে ভাইয়ে একটি পরিবার হয়ে একত্রে মিলেমিশে বাস করা দেখলে সমাজের চোখ টাটাবেই।

তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় শুনেছি খুব পরিশ্রমী লেখক ছিলেন। সারাক্ষণ লিখতেন, প্রচুর লিখতেন। তিনি তার লেখায় সমাজের সংসারের অনেক কিছুই যেমন তুলে এনেছেন তেমন‌ই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনার জন্য আলাদা একটি দৃষ্টিকোণ থেকেও সমাজকে দেখিয়ে দিয়েছেন, যেটা আমরা কখনো ভাবতেও পারি না তেমন‌ই আধুনিক চিন্তাধারা সেই আমলের একজন লেখকের মস্তিষ্কপ্রসূত লেখায় বের হয়ে এসেছে,ব্যাপারটা সত্যি মুগ্ধ করার মতো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top